অন্য রঙের ভালবাসা
সুনিতা বিশ্বাস
আরে কি করেছিস, চায়ে এতো মিষ্টি দিয়েছিস কেন, খাওয়াই যাচ্ছে না, স্বাদেও যেন কি একটা মিসিং , ধুর সকাল বেলায় মুড টাই খারাপ হয়ে গেলো। এতোটা বলে থামলো অভিশ।
আমি বললাম আজ মায়ের বাড়ি যাবো।
আমার কথার সাথে সাথে উত্তর এলো “ এতে এতো রাগের কি হল যে ও বাড়ি যেতে হবে তোকে।“
আমি বললাম “পরশু বাবা মায়ের অ্যানিভারসারি, এবার তো আমি নেই ওখানে। ছোট করে হলেও কিছু একটু আয়োজন তো করতাম, তাই যাবো ।“
ও তাই বল আমি ভাবলাম রাগ দেখাচ্ছিস।
যাকগে এখন যেতে হবে না তোকে ঐ বাড়ি, এখন নয় কাছাকাছি আছিস তাই বলছিস,যদি দূরে বিয়ে হতো তোর তখন তো আর হুটহাট করে যেতে পারতিস না।
বাদ দে, যা আর এক কাপ চা করে দে ভালো করে।
পারবো না, নিজে করে নে।
আভেরি এতো রাগ কিন্তু ভালো নয় বলে দিচ্ছি। অভিশের ঝাঁঝালো রি-অ্যাকশন ।
রেগে গেলে অভিশ আমাকে আভেরি বলেই ডাকে।
আমি আর কথা না বলে চলে গেলাম রান্না ঘরে। রান্না সেরে টিফিন বক্স গুছিয়ে ডাইনিং টেবিলে রেখে অন্য ঘরে গিয়ে বসে আছি।
এর মধ্যে অভি অফিসের জন্য রেডি হয়ে আমার কাছে এলো, আমি ভাবলাম সরি বলবে হয়তো। ভুল ভাঙলো ওর কথায়। “আজ একটা মিটিং আছে… ফিরতে দেরী হবে।“
তারপর ব্রেকফাস্ট সেরে টিফিন বক্সটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো অফিস। বেড়ানোর সময় ঠিকভাবে বলেও গেলো না। অভি বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রতিদিন এই সময় বাকী রান্না গুলো সেরে স্নানে চলে যাই। কিন্তু আজ একদম ই ইচ্ছে করছে না কিছু করার। টেবিলে পড়ে থাকা পুরনো ম্যাগাজিন গুলো ঘাটতে লাগলাম । তাতেও মন বসলো না। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলাম পুরনো স্মৃতির মধ্যে। সেই কলেজ জীবনে। প্রথম প্রথম তো আমি চুপচাপ থাকতাম , নতুন পরিবেশ, কিছুটা সময় লেগেছিল সবার সাথে মিশতে। বন্ধু জুটেছিল কয়েকজন, তার মধ্যে অভিশ একজন। অভিশ রায়। মেধাবী ছাত্র। বেশ মিশুকে । সরল মনের মানুষ। কলেজের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমার আর অভির বন্ধুত্বটা অনায়াসেই ভালোবাসায় পরিণত হল। কলেজের কয়েকটা বছর যেন এক মুহূর্তের মত কেটে গেলো । তারপর সেই কঠিন জীবন, পড়া শেষ, চাকরির খোঁজ। অভি ভালো স্টুডেন্ট তাই পাশ করার কিছুদিনের মধ্যেই ভালো একটা চাকরি পেয়ে গেলো। আমার চাকরির খোঁজ তখনও চলছে। অভি যথা সম্ভব হেল্প করতো ,সাহস যোগাতো” চিন্তা করিস না, ঠিক পেয়ে যাবি।“
অবশেষে বেশ কিছুদিন পর পেলাম একটা চাকরি। কাটলো কিছুদিন এভাবে।
তারপর বিয়ে পর্ব টা সেরেই ফেললাম আমরা। এতগুলো বছর ভালোবাসার সম্পর্ক তবু বিয়ের পর যেন সব-ই নতুন লাগছে। সব-ই কাটছে যেন স্বপ্নের মতো। হঠাৎ-ই একদিন সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলো অভির কথায় “ তোকে আর চাকরি করতে হবে না, ছেড়ে দে।“
আমি তো অবাক “বিয়ের আগে তো বলিস নি যে তোর কোন প্রবলেম আছে, বিয়ের পর সবে ২মাস এখন এই কথা বলছিস।“
হ্যাঁ বলছি, কারণ আছে, পরে বলব তোকে সব। জানি তুই খুব জেদি, তোর ভালোর জন্যই বলছি ।তোর কাছে আমার কথার দাম থাকলে আশা করি আমার কথা রাখবি। বলেছিল অভি।
মাকে সেদিন ফোন করলে মাও অভিকেই সমর্থন করেছিল। আমার আর কিছুই বলার ছিল না, মেনে নিতে হয়েছিল সেই সিদ্ধান্ত।
তারপর থেকে তো শুধু ঘর সামলাই , সবটাই অভ্যাস হয়ে গিয়েছে।
সবটাই তো চলছিল নর্মাল ভাবে। ঝগড়া যে হতো না মাঝে মাঝে তা নয় তবে আজকের মতো রুড আচরণ করতে দেখিনি, বাবার কাছে যেতে তো কোনদিন মানা করেনি বরং নিজেই অফিস যাওয়ার পথে আমাকে ড্রপ করে দিতো। তবে আজ হল টা কি । চিন্তার বেড়াজাল ভেদ করে ফোন বেজে উঠলো। অভির ফোন। “কিরে খেয়েছিস? নাকি রাগ কমেনি! “
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দুপুর ১ টা বেজে ১৫।
“ কিরে চুপ করে আছিস যে, আমি কিন্তু এখনও খাইনি, রাগ করিস না সোনা, সরি সকালের জন্য। “
আমি বললাম হ্যাঁ ঠিক আছে রাখছি।
অলস শরীরে উঠে গিয়ে স্নান সারলাম , সকালে বানানো রুটি তরকারি খেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ফোনের আওয়াজ… হ্যালো হ্যাঁ দিদি শোন কাল তুই আর অভিদা কিন্তু চলে আসবি তাড়াতাড়ি।
বললাম আচ্ছা।
ভালো থাকিস দিদি। রাখছি বলে ফোন রেখে দিলো আহেলি।
আবার ফোন অভির “ খেয়েছিস তো? আর শোন তোকে আর কিছু রান্না করতে হবে না, আমি খাবার নিয়ে ফিরবো। “
আমি বললাম হ্যাঁ ঠিক আছে।
রাতে খাবার টেবিলে খেতে বসে অভি বলল “ রেডি থাকিস কাল, বেরবো আমরা।“
আমি বললাম “আহেলি কাল যেতে বলেছে তোকে আর আমাকে। “
না কাল হবে না, অন্য কোনদিন যাবো।
তবে আমাকে ও বাড়িতে নামিয়ে দিবি কাল।
বললাম তো কাল হবে না, পরশু বিবাহ বার্ষিকী বললি তো , সেদিন দেখা যাবে।
রাত তখন ১২ টা , অভি আমাকে ডাকলো এই আভা ওঠ ।
আমি বললাম ঘুমাতে দে না।
আরে পাগলি ওঠ জলদি বলে ধাক্কা দিলো, আমি ধড়ফড় করে উঠে বসলাম, কি হয়েছে ।
কিছু না , হ্যাপি বার্থ ডে ডার্লিং, কেক টা মোমবাতি সমেত সাজিয়ে বলল কেটে ফেলো।
খুশীতে চোখের কোণে জল আমার, তোর মনে ছিল।
হ্যাঁ সব মনে আছে , ছিল , থাকবে , নে ইমোশনাল না হয়ে এবার কেক টা কেটে ফেল।
হ্যাপি বার্থ ডে টু আভা বলার সাথে সাথে কেক কাটা শেষ। খাওয়ার চেয়ে ক্রিম মাখামাখি তেই বেশি আনন্দ পেলাম আমরা। আমি অভিকে জড়িয়ে ধরে বললাম থ্যাঙ্ক ইয়উ।
বিয়ের পর এটা আমার প্রথম জন্মদিন, তুই এভাবে পালন করলি।
অভির মুখে দুষ্টু হাসি, বিয়ের আগে চান্স কোথায় পেতাম এভাবে তোকে কাছে পাওয়ার।
যাহ শয়তান।
আহা লজ্জা পেলে তোকে ঠিক আগের মতোই লাগে। মেইনু ইশক তেরা লে ডুবা।
আচ্ছা হল , এবার যা তো ঘুমা।
হুম কাল তো আবার বেড়ানো আছে। ওকে গুড নাইট।
সকালে উঠে দেখি অভি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে।
আমি এক চুমুক খেয়ে বললাম, এটা চা হল, মিষ্টি কম।
তাই, কাছে আয় মুখ মিষ্টি করে দিচ্ছি, চা মিষ্টি লাগবে তখন।
ধুর কিছু বলার-ই নেই।
না না আছে অনেক কিছুই বলার আছে। বলবো তোকে আজ নয়তো কাল। এটা তোর গিফট বলে একটা আকাশি রঙের ডিজাইনার শাড়ি দিয়ে বলল রেডি হয়ে নে।
রেডি হয়ে বেড়াবো, দেখি অভি তাকিয়েই আছে আমার দিকে।
অ্যাই কি হলো, কি দেখছিস।
আমার নজর লেগে যাবে, কাজের চাপে তোকে ভালো করে দেখার টাইম পাই না তো তাই দেখছি এখন।
আচ্ছা কোথায় যাবো আমরা?
চল না, যেদিকে দুচোখ যায় নিয়ে যাবো তোকে।
অভি আমাকে নিয়ে মন্দিরে পুজো দিলো, দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে মিষ্টির প্যাকেট , দুটো শাড়ি আর একটা ঘড়ি কিনল। তারপর বাইক এগিয়ে চলেছে আমার চেনা অলি গলি পথ দিয়ে। আমি বললাম এদিকে কোথায় যাচ্ছিস।
চল না, অতো অস্থির হলে চলে।
অবশেষে দেখি অভি আমার বাড়ির সামনেই বাইক দাঁড় করালো।
মাকে দেখলাম বারান্দা তেই দাঁড়িয়েছিল।
এসো এসো ভেতরে এসো, সাদর সম্ভাষণ।
আপনার মেয়ে মায়ের কাছে আসার জন্য কান্নাকাটি জুড়েছিল তাই নিয়ে এলাম।
মা শুধু হাসলো।
আমি বললাম বাড়ি চল তোর হবে।
হে হে । দেখা যাবে।
মা অনেক আয়োজন করেছে আমার জন্মদিনের জন্য। বাড়ি ঘর ফুল দিয়ে সাজানো। অভি মিষ্টির প্যাকেট টা মায়ের হাতে দিয়ে আহেলির ঘরে গেলো।
আমি বললাম মা এতো সব সাজানো …
সব অভি আর আহেলি মিলে করেছে ।
আন্দাজ করলাম দুটো তে মিলে কিছু প্ল্যান করেছে।
পরের দিন দেখলাম সত্যি বেশ বড় প্ল্যান করেছে এরা।
আমি আর অভি গিফট গুলো দিয়ে প্রণাম করলাম বাবা মাকে।
আহেলি গিফট পেয়ে বেশ খুশি।
লোক জন হই হুল্লোড়, রাত বাড়ার সাথে সাথে ভিড় কমেছে।
অভি আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে গেলো, বল কেমন লাগলো সারপ্রাইজ টা। ভাষাহীন আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
অভি বলল বাবা মায়ের ৪০ বছরের বিবাহ বার্ষিকী এভাবেই তো পালন করতে চেয়েছিলি। জানিস তো আমারও ইচ্ছে ছিল বাবা মায়ের বিবাহ বার্ষিকী , জন্মদিন পালন করবো, ঠিক যেভাবে আমার জন্মদিন পালন করা হতো। কিন্তু আমার ভাগ্য তো জানিস-ই যখন স্কুলে পড়ি তখন বাবা চলে গেলেন আর চাকরি পাওয়ার পর মা। তবু তুই পাশে আছিস বলেই বাঁচার ইচ্ছে টা বেড়ে যায় অনেকটা।
মন খারাপ করিস না। পাশে আছি, থাকবো।
অভি এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরল, এই নে বলে একটা চাবি দিলো, এটা আমাদের সামনের বাড়ির ফার্স্ট ফ্লোর, ওখানে তুই রান্নার ক্লাস করাবি, আহেলি থাকবে তোর সাথে। এটা তোর জন্য বার্থ ডে গিফট । এটা তোর স্বপ্ন, চাকরি টা ছাড়তে বলেছিলাম শুধু এই কারণেই । সরি তোকে কিছু দিন ঘরে বসে থাকতে হল বলে ।
এতো ভাবিস তুই আমার জন্য। এতোটা ভালোবাসিস।
হ্যাঁ এতটাই ভালোবাসি। আরও একটা কথা বলবো রাগটা করবি না তো…
না।
পরশু সকালে যে চায়ের ঘটনা টা, ওটা আমি ওভার রি-অ্যাক্ট করেছিলাম, মানে চা ঠিক-ই ছিল। এগুলো সব আহেলির প্ল্যান। সরি , ক্ষমা করে দে।
আহেলির প্ল্যান, ওর তো হবে ব্যবস্থা। আর তুই পারলি আমার সাথে সাত সকালে ওমনি খারাপ ব্যবহার করতে। সারাটা দিন সেদিন কতো খারাপ লেগেছে জানিস।
অভি জড়িয়ে ধরে বলল” না আর কখনো আহেলির কথা শুনবো না। এবার নিচে চল, নইলে বাবা মা ভাববেন মেয়ে জামাই ছাদে প্রেম করছে।“
আমার জন্মদিন আর এই এতো বড় অনুষ্ঠান দারুণ সারপ্রাইজ দিয়েছিস তুই। কখনো ভুলবো না।
আভা আমাকেও মনে রেখো প্রিয়ে।
অভি…
তোমাকে মনে রাখবো প্রিয়,
মনে রেখো তুমি আমায়।
পলাশের রঙে রঙিন মনের আঙিনায়,
বসন্ত আজও শুধু তোমার-ই অপেক্ষায়…।।