চিঠি
– উৎপল দাস
অর্চন জ্যোতি কর্মকার তার শান্ত স্বভাব আর পরোপকারী মনোভাবের জন্যে সর্বজন প্ৰিয়। পেশায় ডাকপিওন। এই ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসেই তার চাকরির দুবছর পূর্ণ হলো।
ওর গ্রামের দ্বারে দ্বারে চিঠি পৌঁছে দেয়া তার অত্যন্ত প্রিয় কাজ। চিঠি পৌঁছে দিয়েই শেষ নয়, গ্রামের অধিকাংশ মানুষ নিরক্ষর। চিঠিতে কি লিখা তা পড়ে শোনাতেও হয় তাকে। কাজের ফাঁকেই সে গ্রামের লোকজনদের খোঁজখবর নেয়। কাউকে আবার চিঠির উত্তরও লিখে দেয় অর্চন। প্রতিটি চিঠি ঠিকানার খোঁজে বিভোর থাকে। চিঠির আদান প্রদান করে অর্চন এক বিশাল মানসিক শান্তি পায়। সুদূর এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তের মানুষগুলো যখন প্রিয়জনদের চিঠি পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয় তখন খুব ভালো লাগে তার।
ক্লিং… ক্লিং… সাইকেলের বেল্ বাজতেই এক কুঁড়ে ঘর থেকে ডাক পড়লো, “অর্চন এসেছে… অৰ্চন… কিগো, শুনছো… তাড়াতাড়ি আসো … ক্ষেতে পরে নিরি দিও…. ” ষাট কিংবা পঁয়ষট্টি বয়সের গ্রামের এক মহিলা তাঁর স্বামীকে ডাকছে।
অৰ্চন সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লো।
“মাসিমা, কেমন আছো গো, ভালো তো ? মেসোকে বলো আসতে … নির্মলের চিঠি এসেছে । ”
মাটির বারান্দায় পিঁড়ি সাজানো। উঠোনে পা ঝুলিয়ে সেখানে বসে পড়ল অর্চন। ছোট্ট দুটো ছনের ঘর, চড়ুই পাখি গুলো কিচির মিচির করছে আর ছন খুলে নিয়ে যাচ্ছে ঠোঁটে করে। উঠোনের এক কোণে ছোট্ট একটা ভাঙা রান্না ঘর। এক পাশের বেড়া নেই। মাটির দেয়াল ঘরটির অধিকাংশ ছন পঁচে নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টির জল পরে মাটির দেয়াল গুলো অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত।
তাঁদের একমাত্র সন্তান নির্মল রাজস্থান থাকে। সেখানেই তার রোজগার।
“আমার বাপ্ চিঠি পাঠিয়েছে !! কি লিখেছে ? “- ক্ষেত থেকে আশি ছুঁই ছুঁই বয়সের বৃদ্ধ নির্মলের বাবা এসে বললেন।
অর্চন এক গ্লাস জল খেয়ে তার চিঠির ঝুলি থেকে চিঠি বের করে পড়তে লাগলো –
“পরম পূজনীয় বাবা ও মা, প্রণাম নিও। এখানে আমি খুব ভালো আছি। তোমরা আমার জন্য কোনো চিন্তা করবে না। মানিঅর্ডার এ ৩০০ টাকা পাঠালাম। ঘরে নতুন ছন লাগিও। মাকে একটা শাড়ি আর ব্লাউজ কিনে দিও। তোমার জন্য ধুতি আর একটা শার্ট কিনে নিও। আমার ছুটি নেই। কবে আসবো বলতে পারছিনা। তোমরা ভালো থেকো। প্রণাম।”
চিঠি পড়া শেষ। কিন্তু কেউই কিছু বলছে না। মায়ের চোখে জল, বাবার নিঃশব্দ কান্না যেন সকালটাকে রাতের আঁধারের মতো করে দিয়েছে। অৰ্চনও নিজের চোখের জলকে বাগ মানাতে পারেনি।
“আজ দু’ বছরের উপর হলো, আমার কলিজার টুকরোটাকে দেখিনা। টাকা দিয়ে কি করবো বলো? আমার আত্মাটা তো আমার ছেলের কাছে গো ”
মায়ের চোখের জল, বাবার নিশ্চুপ থাকা, এইসব দেখে সহ্য হচ্ছে না আর অর্চনের।
“মাসি, আমিও তো তোমাদেরই ছেলে। আমি তো আছি, ভাই বাড়িতে নেই তো কি হয়েছে, আমি তো আছি। কেঁদো না। এই নাও ৩০০ টাকা।”
আজ আর চিঠির উত্তর লিখতে বলেনি মাসি মেসো কেউ। টাকাটা হাতে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অৰ্চন।
অর্চনের একটি ছোট্ট মেয়ে আছে, নাম মিষ্টি। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতেই আনন্দে দৌড়ে অৰ্চনের কোলে উঠে আসে মিষ্টি।
— “বাবু, আমার চকলেট কই?”
মিষ্টির পছন্দ কাঠি চকলেট।
— “এইতো এনেছি মামনি, নাও নাও। ”
আজ অৰ্চনের মনটা খুবই বিষণ্ণ। মেয়ে মিষ্টির হাতে চকলেট দুটো ধরিয়ে দিয়ে সে তার স্টাডি টেবিলে বসে পড়লো।
— “ও বাবু, কি লিখো? চিঠি? কাকে লিখো গো? বলোনা … ও বাবু।”
মেয়ের নিষ্পাপ চেহারাটি দেখে মনটা যেন ভালো হয়ে গেলো অৰ্চনের।
— “হ্যা মামনি, চিঠিই তো আমার কাজ। যাও যাও, দেখো মা কি করে, যাও যাও যাও”
রান্না ঘরে মিষ্টির মা সুপর্ণা বিকেলের জল খাবার বানাতে ব্যস্ত। মিষ্টি এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেলো।
— “মা.. মা … জানো, বাবু চিঠি লিখে, কিগো.. কাকে লিখে…?”
বলেই আবার খেলায় মত্ত হয়ে গেলো ছোট্ট মিষ্টি। এদিকে জলখাবার তৈরি। প্লেটে করে সাজিয়ে নিয়ে সুপর্ণা এগিয়ে এলো অৰ্চনের দিকে।
“কিগো পোস্টম্যান সাহেব, কাকে লিখো চিঠি? হুম….??? সারাদিন তো অন্যের চিঠি নিয়েই কাজ তোমার। তুমি কাকে লিখো আবার?”
বলেই টেবিলে রাখা একটি চিঠি হাতে নিলো সুপর্ণা। নজর এক্কেবারে চিঠির শেষের দিকে, সেখানে লেখা ” ইতি তোমার ছেলে নির্মল।”
” হে…. নির্মল? এটা তো তোমার হাতে লেখা চিঠি, তো শেষে নির্মল লিখলে যে !!”
— “নির্মল…. খগেন্দ্র মেসোর ছেলে।”
বলেই ভারাক্রান্ত হয়ে চেয়ারে বসে পরে অৰ্চন।”
সুপর্ণা অৰ্চনের কাঁধে পরম স্নেহে হাত রেখে বলে -“কিগো বলোনা আমাকে সম্পূর্ণ বিষয়টা”
অৰ্চন বললো – “১৯৯৩ সনে আমার বাল্যবন্ধু নির্মল রাজস্থান যায়, কিছু রোজগারের আশায়। একটা কাজও পায় সে। মানিঅর্ডার এ প্রতি মাসেই টাকা পাঠাতো সে বাড়িতে। ৯৪ সালে যখন আমি পোস্ট অফিসে জয়েন করলাম, তখন ওর বাড়িতে আমিই দিয়ে আসতাম মানিঅর্ডারের টাকাটা। নির্মলের সমস্ত চিঠি আমিই পড়ে শোনাতাম মাসি মেসো কে। সব ভালোই চলছিলো। ৯৪ সালে তোমার আমার বিয়েতেও এসেছিলো নির্মল। তারপর যখন গেলো, আর আসলো না, চিঠিও পেলামনা ছয়মাস। অনেক কষ্টে জানতে পারলাম যে নির্মল নিখোঁজ। মাসি মেসোর একমাত্র ছেলে নিখোঁজ !!! মানতে পারলাম না। মাসি মেসো যে মরেই যাবে গো ! তখন থেকে আমিই চিঠি লিখি আর নিয়ে পড়ে শোনাই। মাসে মাসে ৩০০ টাকা দেই মাসি মেসোর হাতে আর বলি যে নির্মল পাঠিয়েছে ! এই বৃদ্ধ বয়সে মাসি মেসোকে দেখবে কে ? আমি পারিনি গো ওদের বলতে যে নির্মল নিখোঁজ… নির্মল নেই… !!!”
অজস্র কান্নায় ভেঙে পরে অৰ্চন। সুপর্ণা অর্চনের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের কাঁধে ঠেকিয়ে বলে — “তুমি ঠিকই করেছো গো। আচ্ছা শোনোনা… আমার তো শশুর শাশুড়ি কেউই নেই। মাসি মেসোকে যদি নিয়ে আসি আমাদের বাড়িতে ! বলোনা আসবে তো তাঁরা?”
সুপর্ণাও নিজের চোখের জলকে আটকে রাখতে পারেনি। শাড়ির আঁচলে নিজের আর অর্চনের চোখ মুছে দিয়ে বললো- “কিগো শোনোনা…. ওদের কাছে সত্যটা লুকানো আর ঠিক হবেনা ”
— “হ্যাঁ…. তবে জানো সুপর্ণা ? এই সত্য কথাটা বলা খুবই কঠিন আমার কাছে। তুমি আমার পাশে থেকো সুপর্ণা, আমি বলবো।
সুপর্ণা, আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবান গো যে তোমার মতো একজন জীবনসাথী পেয়েছি”
একটা তৃপ্তির মৃদু হাসি হেসে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো পরম স্নেহে, গভীর এক অন্তহীন ভালোবাসায়।