ছোটগল্প-শেষ চিঠি
লেখক-বিরাজ বর্মন
দীর্ঘবছর পর আজ আবার রবিনবাবু এসে লেকের ধারের কাঠের বেঞ্চিটায় বসলেন,অনেক বয়স হয়েছে ওনার,ছমাস হল সত্তর বছরে পা দিলেন,প্রায় চল্লিশ বছর পর আজ আবার এসেছেন এই লেকের ধারে। আজ যেন সবকিছু অচেনা হয়ে গেছে ওনার কাছে ..এই লেক,এই বেঞ্চিটা,অথচ অনেকগুলো বছর আগেই কত আপন ছিল সবকিছু,রোজ বিকেলে লেকের ধারের এই বেঞ্চিটাতে বসেই একদিন রীতার হাতে হাত রেখেছিলেন, প্রেম নিবেদন করেছিলেন রীতাকে,কতদিন রীতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতেন এই বেঞ্চিটাতে বসে,আর রীতা রবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। কত ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছিলেন দুজনে মিলে,কত প্রতিশ্রুতি,কত মান-অভিমান হত ওদের মধ্যে ।কিন্তু কি জানি হয়তো ভগবান কাউকে এত সুখ দেননা! সেদিন ছিল এক বসন্তের বিকেল,রীতা কথা দিয়েছিল রবিনকে, ঠিক পাঁচটে নাগাদ আসবে লেকের ধারে। কিন্তু না আসেনি রীতা সেদিন, রবিন অপেক্ষা করতে করতে একসময় ফিরে গিয়েছিল ঘরে। খবরটা রাতে পেয়েছিল রবিন,রীতা আর নেই…. গাড়ির ড্রাইভারের ছোট্ট ভুলের মাশুল দিয়ে চিরকালের মতো পৃথিবী ছেড়ে হারিয়ে গেছে সে । না,রবিন আর শেষদেখাটা করার সাহস পায়নি,সেদিন প্রথমবারের মতো ঘরের দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছিল ও। না আর কখনো সেই লেকের ধারে যায়নি রবিন,পরের বছরই রিসার্চ করতে সুযোগ পেয়ে কানাডা চলে গিয়েছিল,চারবছর পর একটা চাকরীও পেয়ে গেছিল ওখানে। তারপর শুধু গুনে গুনে পাঁচবার এসেছিল দেশে,তবে লেকের ধারে আর আসা হয়নি,বিয়ে থাও আর করেননি রবিনবাবু,তবে দেশে ফিরে সেবার রাস্তায় কুঁড়িয়ে পাওয়া একটা বাচ্চাকে দত্তক নিয়েছিলেন। রবিনবাবু দেখতে পান লেকের ধারে একটু দূরে আরেকটা বেঞ্চিতে বসে এক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল, রবিনবাবু হারিয়ে যান পুরোনো স্মৃতিতে,নিজের মনেই বারবার করে উচ্চারণ করেন-‘রীতাʼ নামটা,তারপর পকেট থেকে একটা বহুপুরনো চিঠি বের করেন, তারপর বয়সের ভারে অনভ্যস্ত হাতে তৈরি করেন একটা নৌকা,তারপর ভাসিয়ে দেন লেকের জলে। রীতার জন্য সেদিনও একটা চিঠি লিখেছিল রবীন,কিন্তু দেওয়া হয়নি আর,পরম যত্নে রয়ে গেছিল রবীনের কাছেই। হালকা হাওয়ায় দুলতে দুলতে এগিয়ে যায় চিঠির নৌকোটা,রবীনবাবু এক পলকে চেয়ে থাকেন সেদিকে,নিজের অজান্তেই গভীরভাবে শ্বাস ফেলার আওয়াজ বেরিয়ে আসে তার মুখ দিয়ে।ইতিমধ্যেই গোধূলির আলোতে আকাশ জুড়ে যেন রং এর উৎসব শুরু হয়েছে,জলে তার ছায়া পড়ে হয়ে উঠেছে আরও বেশি মায়াময়, আর সেই মায়ার জগতে যেন একটু একটু করে হারিয়ে যান রবীনবাবু।(সমাপ্ত)