সপ্নের গেলজিয়ানরা
লামিমা
“মা আজ ক্লাসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমি বড় হয়ে কি হতে চাই।” মাকে উদ্যেশ্য করে আমি বললাম।
“তুই কি বললি?”মা বলল।
“আমি বললাম ,বড় হয়ে বিশ্ব ঘুরব।”
“কি?”
“হ্যা, মা।”
বাবা বলল,“বিশ্ব ঘোরার টাকা পাবি কোথায়?”
“সেটা তখন বোঝা যাবে।” উত্তর দিয়ে বললাম আমি।
“হয়েছে এসব আজগুবি চিন্তা বাদ দে, আর ঘুমো।”মা বলল।
বিছানায়-
“বিশ্ব ঘুরলে সমস্যা কোথায়?কত জিনিস জানতে পারব। কত নতুন কিছু শিখব।” মনে মনে বললাম আমি।
ঘুমথেকে উঠে নিজের মধ্যে অনেক বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। বললাম “মা”
লক্ষ্য করলাম গলার স্বরেও এসেছে পরিবর্তন।
দেখলাম আমি বিছানায় নয় ফ্লাইটের সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। আশেপাশে সব অচেনা মানুষজন। এটা কি কখনো সম্ভব? এটা কি টাইম ট্রাভেল? মনে হাজারো প্রশ্নের উদয় হলো।
এমন সময় পাশে বশে থাকা এক র্বদ্ধ আমাকে প্রশ্ন করলেন,“তোমার নাম কি বাবা?”
হঠাৎ করে ওনার কথা শুনে খানিকটা অপ্রস্ততভাবে বলে উঠলাম, “আমার নাম রাহান।”
“কোথায় থাক?”
“ঢাকার গোড়ানে।”
“ও,বয়স কত হলো?”
উনি বয়সের কথা বলায় মনে আরও একটা প্রশ্ন জাগল।আমার বয়স কত?”
আমার উত্তরে দেরি হওয়ায় বৃদ্ধ হেসে বললেন, “বয়স ভুলে গেছ বুঝি?”
“আজ্ঞে, ওই।”
“কি করো?”
“বিশ্ব ঘুরি।”
“এককথায় ভবঘুরে?”
“বলতে পারেন।”
“হঠাৎ গেলজনে?”
“এটা গেলজনের ফ্লাইট”
“হ্যা, পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দেশ।”
“ও!”
ফ্লাইট মাটিতে অবতরণ করেছে। আমি বের হয়ে এয়ারপোর্টে নামলাম। চারপাশটা খুব সুন্দর। আমি গেটের দিকে হাঁটছি।
হঠাৎ করে সামনে তাকিয়ে দেখিলাম একটা লাশ। ভাবলাম চিৎকার করব কিন্তু ভেবে অবাক হলাম যে চারপাশে কতগুলো লোক হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু কেউ কোনো রিঅ্যাক্ট করছে না। এক মহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। হ্যান্ডসেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ,
“হাই, আমার নাম গ্লাভারা। আপনার নাম?”
“হ্যালো, আমার নাম রাহান। আচ্ছা, এই লাশটা এখনে এভাবে কেন?”
এবার মনে হয় আমার উপেক্ষা করাটার প্রতিশোধ নিয়ে আমার কথাটা উপেক্ষা করে উনি বললেন,
“ব্যাবসার কাজে এসেছেন বুঝি?”
“না, আমি বিশ্ব ঘুরি।”
“তা এখানে থাকবেন কোথায়?”
“জানি না।”
“কোথায় থাকবেন, কি খাবেন সেটাই জানেন না, আবার এখানে এসেছেন। চলুন, আমার বাড়ি চলুন। বাড়িতে ছয়টা ঘর। আমি একাই থাকি।”
রাতে-
আমরা দুজন বারান্দায় একটা কালো কাচের টেবিলে বসে চা পান করছি। টেবিলটা সুন্দর। আসলে এখানকার সবকিছুই খুব সুন্দর, পরিপাটি।
হঠাৎ গ্লাভারা বলল,“তখন জিজ্ঞেসা করেছিলেন না, লাশটা ওখানে ওভাবে পড়ে আছে কেন? সবই বলব।”
“মানে?”
“মানে আমাদের শহরের বিচিত্রতার কথা, গেলজিয়ানরা কি পারে, কি পারে না সব বলব।”
“আপনি বাংলা জানেন কিভাবে?”
“আমাদের ভাষা গিলাজান হলেও আমরা পৃথিবীর সব ভাষা জানি।”
“কেমন?”
“যেমন, ‘আমার নাম গ্লাভারা’ এই কথাটাকে ইংলিশে বললে, ‘মাই নেম ইস গ্লাভারা’ হয়। হিন্দিতে বললে, ‘মেরা নাম গ্লাভারা হেয়’ হয়। আরবিতে বললে, ‘আইসমি গ্লাভারা’ হয়।………………………….”
এভাবেই গ্লাভারা আরো প্রায় ৩৪টা ভাষায় বাক্যটা অনুবাদ করে দেখালো। আমিও অভিভূতের মতো শুনে গেলাম। তারপর গ্লাভারা বলল,“আমাদের এখানে নতুন তো তাই সবকিছু জানেন না। আমাদের এখানে আছে নানা ভয়ঙ্কর জিনিস, আছে নির্মম জিনিস। জুমপার কথা শুনেছেন?”
“জুমপা আবার কি?”
“আপনাদের ভাষায় ডাকাত বলতে পারেন। তবে এরা সাধারণ ডাকাত নয়। অন্যদের মতো এরা টাকা-পয়সা লুটপাট করে না। মানুষকে কিডন্যাপ করে তাদের বুক কেটে ফুসফুস থেকে সোনার বিস্কিট বের করে নেয়। আমাদের নিজস্ব এক ধরণের ক্যাবেজ রয়েছে যেটা বিদেশে রপ্তানি করা হয় না, নাম ‘গোল্ড ক্যাবেজ’ এটা প্রতিদিন খেলে ফুসফুসে সোনার বিস্কিট হয়।”
আরেকটু হলেই আমি মাথাঘুরে পরে যাচ্ছিলাম। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বসলাম। কারণ আমি আন্দাজ করতে পারছি যে এরকম আরও অনেক কিছু শুনব।
বললাম, “আপনারও আছে?”
“না, আমি গোল্ড ক্যাবেজ খাই না। এত মনে করে প্রতিদিন খেতে ইচ্ছে করে না। আর তাছাড়া স্বাদও খুব একটা ভালো না। খানিকটা সিদ্ধ ভুট্টার মতো।”
কথাটা বলতেই গ্লাভারা হেসে উঠল। আমিও ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য হাসলাম। যদিও হাসার মতো মুডে আমি তখন ছিলাম না।
এত বড় বাড়িতে একা একা থাকতে নিশ্চয়ই গ্লাভারার একটু হলেও বাবা অথবা মায়ের শুন্যতা অনুভব করা উচিত। তবে এখানে আসার পর থেকে তেমন কোনো অনুভুতি আমি গ্লাভারার মধ্যে দেখিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম,
“আপনার মা-বাবা কোথায় থাকেন?”
“বাবা তো নিরুদ্দেশ। প্রায় ১৬-১৭ বছর আগের কথা। পরিবারে আমরা তিনজন ছিলাম। আমি, বাবা আর মা। আমার বাবার নাম বাহ্ইয়া।আর মায়ের নাম গ্লিজা। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বাইকে চড়ে সমুদ্রে চলে গিয়েছিল। তারপর একটা বোট ভাড়া করে নিয়ে চলে গেল। আমরা তখনো ঘুমোচ্ছিলাম। পুরোটাই প্রতিবেশিদের কাছ থেকে শোনা। জানি না সত্যি কিনা।”
“আর মা?”
“সত্যিই শুনতে চান মায়ের কি হয়েছিল?”
“হ্যা।”
“একান্তই যখন শুনতে চান কি হয়েছিল, তাহলে শুনুন। তখন আমার বয়স মাত্র এগারো বছর। পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলাম। বিনোদন কার্যক্রম করার সময় ছিল না। শুধু পড়াশোনার জন্য খুব কষ্ট করে বছরে একবার সার্চ ইঞ্জিনে তথ্য দেখার সুযাগ পেতাম। একদিন একটু তাড়াতাড়ি পড়া শেষ হওয়ায় বাবার পুরোনো মোবাইলটা নিয়ে একটু দেখতে বসেছি। এমন সময় হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি মা একটা সুচালো কাচি নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। নিজের প্রাণ বাঁচানোর প্রয়োজন বোধ করলাম। তাই সোফার পাশের টুলে রাখা ফ্রুট প্লেটে থাকা ছুড়িটা হাতে নিয়ে মায়ের পেটে চালিয়ে দিলাম।”
আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারলাম না যে আমি একটা খুনির সামনে বসে আছি।
একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না, এখানকার মানুষ এত অপরাধ করে, কিন্তু কােনো পুলিশের দেখা নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম,“আপনাদের এখানে অপরাধ দমনের জন্য পুলিশ নেই?”
“না, নেই। আমাদের এখানে কেউ খুন করলে নিজ দায়িত্বে কবর খুতে পুতে দিতে হয়। সহজ ব্যাপার, তাই না?”
“হ্যা”
“এভাবেই গল্প করতে করতে রাত কাটিয়ে দেবেন, না ঘুমোবেন? যান ঘুমোতে যান।”
আমরা নিজের নিজের ঘরে চলে গেলাম।
পরদিন সকালে-
সকাল থেকে মন চাইছিল একটু অন্যরকম কোথাও যাওয়ার। তাই লেক ঘুরতে চলে এলাম।
লেকের চারদিকে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। একটা ভালো পোজিশন দেখে বেঞ্চে বসে পড়লাম। একটা প্রজাপ্রতি এসে আমার হাতের ওপর বসে পড়ল। ওটার পাখয়ি যেনি রংধনুর সাত রং ঢেলে দেয়া হয়েছে। এমন সুন্দর প্রজাপ্রতি আমি আর কখনো দেখিনি। সামনে লেকটার ঝকঝকে আলো যেন দৃষ্টি কেড়ে নেয়। চারপাশে সবুজ গাছপালা। এমনি একটা চেরিগাছে উড়ে গিয়ে বসল এক লাল পাখি। একটা ডাল ভেঙে চেরি থোকা নিয়ে এলো আমার কোলে। তারপর ভোরবেলার লালচে আকাশে উড়ে গেল। আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। এখানকার মানুষ যেমন নিষ্ঠুর, পশুপাখি তেমনি নরম মনের।
আমি একটা চেরি নিলাম। আরেকটা প্রজাপতিকে দিলাম। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় তেতুলগাছের ছোট ছোট পাতা উড়ে এসে পড়ল গায়ের ওপর। দূরে একটা মেঠোপথ দেখতে পেলাম। দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
ওখানে একটা লোক একটা বাচ্চার দিকে বন্দুক তাক করে আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেলাম সেখানে। বাচ্চাটাকে সরিয়ে নিয়ে বললাম,“কি করছেন আপনি? একটা ফুলের মতো শিশুকে এভাবে মারতে যাচ্ছিলেন কেন? কোনো মায়া-মমতা নেই আপনাদের মনে?”
লোকটা বলল,“সরে যাও এখান থেকে। ও আমার ছেলে।”
“আপনার ছেলে বলে কি এভাবে হত্যা করতে হবে?”
লোকটা কাউকে কল করে ফিসফিস করে বলল,‘ইমুজ’। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে এক ধরণের নিস্চুপ অন্ধকার নেমে এল। শুধু আবছা হলুদ আলো। আমাদের চারদিকে হাজারো মানুষ এসে হাজির হলো। লক্ষ করলাম সেখানে গ্লাভারাও রয়েছে। সে বলল,“রাহান, আমি আপনাকে বলেছিলাম এখানে এসব নিয়ে মাথা না ঘামাতে!”
লোকটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। গ্লাভারা আর সবাই আমার দিকে এগোচ্ছে। আর বারবার বলছে, ‘গেলজিয়ানরা সব পারে’।
ধিরে ধিরে সবাই আমার খুব কাছে চলে এল। গ্লাভারা আমার দিকে একটা ছুরি ছুড়ে দিল। আমি চোখ বন্ধ করে চিৎকার করলাম,‘আ………………….’।
চোখ খুলে দেখতে পেলাম আমি আর গেলজনে নেই। বিছানায় শুয়ে আছি। সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হলো আমি আবার আগের মতো হয়ে গেছি। পুরোটাই সপ্ন ছিল। চিৎকার শুনে মা এলেন।
বললেন,“চিৎকার করলি কেন? খারাপ সপ্ন দেখেছিস?”
“আম্মু, আমি বড় হয়ে ভবঘুরে হব না।”
“তোর এইমের এই পরিবর্তন কে করল?”
আমি মনে মনে বললাম,
“সপ্নের গেলজিয়ানরা”